বাংলা গানের একটি বিশিষ্ট ধারা। সংস্কৃত কীর্তন [কীর্ত্তি (বর্ণনা করা) +অন (ল্যুট), ভাববাচ্য] শব্দের একাধিক অর্থের ভিতরে বিশেষ কয়েকটি অর্থ হলো- গুণকথন, গুণগানকরণ, স্তবন। এই অর্থের সাথে বাংলা গানের কীর্তন-এর ভাবের সবিশেষ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কীর্তন-এর এই ভাব যেকোনো বিষয়ের গুণকীর্তন নয়। মূলত এর সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে হিন্দু পৌরাণিক দেবতা বিষ্ণু, বিষ্ণুর দ্বাপর যুগের প্রথম অবতার এবং দশম অবতারের অষ্টম অবতার হিসাবে নির্দেশিত শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধার সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলী। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে- কংস নামক এক অত্যাচারী রাজার অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলে, ব্রহ্মা সকল দেবতাদের নিয়ে সমুদ্রের ধারে বসে বিষ্ণুর আরাধনা শুরু করেন। বিষ্ণু সে আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সাদা ও কালো রঙের দুটি চুল দিয়ে বললেন যে, তিনি বসুদেবের ঔরসে দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করবেন। কৃষ্ণের প্রতীক হলো কালো চুল। তাঁর সহযোগী হলেন বলরাম, তাঁর প্রতীক হলো সাদা চুল। এই সূত্রে বসুদেবের ঔরসে দেবকীর অষ্টম গর্ভে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। পক্ষান্তরে রাধাকে কৃষ্ণের প্রণয়িনী হিসাবে দেখা হয়। পদ্মপুরাণ ও ভাগবতের মতে, গোলকধামে কৃষ্ণের বামপাশ থেকে রাধার উৎপত্তি হয়েছিল। জন্মের পর পরই ইনি কৃষ্ণের আরাধনা শুরু করেন। ইনি উৎপত্তিকালে ১৬ বৎসরের নব-যৌবনারূপে কৃষ্ণের সিংহাসনের বামপাশে অবস্থান নেন। এই সময় রাধার লোমকূপ হতে লক্ষকোটি গোপিকা ও কৃষ্ণের লোমকূপ থেকে লক্ষকোটি গোপের জন্ম হয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতে- একবার বিষ্ণু রম্যবনে প্রবেশ করে রমণ ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ফলে কৃষ্ণের ডান অংশ থেকে কৃষ্ণমূর্তি ও বাম অংশ থেকে রাধা মূর্তি প্রকাশ পায়। রাধা কৃষ্ণকে কামাতুর দেখে তাঁর দিকে অগ্রসর হন। রা অর্থ লাভ এবং ধা অর্থ ধাবমান। ইনি অগ্রসর হয়ে কৃষ্ণকে লাভ করেছিলেন বলে- এঁর নাম হয়েছিল রাধা।
ভাবের বিচারে কীর্তন গান হলো- সুর-তাল সহযোগে কৃষ্ণের মধ্য দিয়ে বিষ্ণুর দশম অবতারের গুণকথন বা রাধাকৃষ্ণের পার্থিব লীলার ভিতর দিয়ে ঈশ্বর লীলা অনুধাবনের চেষ্টা। সঙ্গীতের এই বিশেষ ধারার আদি উৎস হিসাবে ধরা হয়, সংস্কৃত ভাষার কবি জয়দেবের রচিত গীতগোবিন্দম্। এই আখ্যানকাব্যে যে পদগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোর সাথে রাগ-তালের নাম পাওয়া যায়। তবে খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ রচিত এই গ্রন্থের পদগুলোর গীতরীতি কেমন ছিল, তা জানা যায় না। এরপর একই ধারায় কীর্তনের সূচনা ঘটেছিল খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর মাধ্যমে। এর ভাষাকে মধ্যযুগীয় বাংলা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই গ্রন্থটি অনেকাংশই গীতগোবিন্দম্ দ্বারা প্রভাবিত। এরপর বা এর কাছাকাছি সময়ে বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস প্রমূখ পদকর্তারা রাধাকৃষ্ণের পার্থিব লীলাকে উপজীব্য করে পদ রচনা করেছিলেন। কিন্তু এই পদগুলো গীতগোবিন্দম্ বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর মতো কোনো অখণ্ড আখ্যান-কাব্য হিসাবে গ্রথিত হয় নি। এ সকল পদের সুর হারিয়ে গেছে।
বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর সূত্রে বঙ্গদেশের পরবর্তী বৈষ্ণব কবিরা সৃষ্টি করেছিলেন রাধাকৃষ্ণের লীলাভিত্তিক এক ধরনের গান। কালক্রমে এই গানের সাধারণ নাম হয়ে ছিল কীর্তন। এই গানের চর্চা বৈষ্ণবদের অদ্বৈতাচার্য, যবন হরিদাস এবং শ্রীবাস পণ্ডিতদের প্রতিষ্ঠিত বৈষ্ণব গোষ্ঠীর ভিতরে প্রচলিত ছিল। সে সময় বৈষ্ণবগোষ্ঠী ক্ষুদ্রাকার একটি গোষ্ঠী হিসেবে নদীয়ায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এঁরা মূলত রাধাকৃষ্ণের লীলা বিষয়ক কীর্তন গান করতেন। ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে শ্রীচৈতন্য বৈষ্ণবগোষ্ঠীর অন্যতম সদ্স্য হিসেবে যোগদান করেন। পরে তিনি এই গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেন। গীতগোবিন্দম্ কীর্তনের মধ্য দিয়ে যে লীলাকীর্তনের ধারা ক্রমে ক্রমে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছিল। শ্রীচৈতন্য বিষ্ণু বা কৃষ্ণের আরাধনার সহজতর উপায় হিসাবে, সুর ও ছন্দে এঁদের নাম ক্রমাগত উচ্চারণের রীতি প্রচলন করেন। এই ধারায় নাম হিসাবে বেছে নেওয়া হলো- হরে (বিষ্ণুর অপর নাম) এবং কৃষ্ণ। এই দুইটি শব্দ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুর-সহযোগে আবৃত্তি করার মধ্য এই কীর্তন ধারাটি প্রচলিত হয়েছিল। মূলত শ্রীচৈতন্য সেকালের কীর্তনের আদলে হরে-কৃষ্ণ মন্ত্রটিকে জপমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন। এই সময় বৈষ্ণবগোষ্ঠীদের কীর্তনের নাম হয় 'লীলাকীর্তন'। পক্ষান্তরে শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত নবতর কীর্তনের নাম দেওয়া হয়েছিল নামকীর্তন। চৈতন্যদেবের সময় নামকীর্তনের ধাক্কায় নদীয়ায় লীলাকীর্তন অনেকাংশই ম্লান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে নাম-কীর্তনের পাশাপাশি লীলা-কীর্তনের চর্চা অব্যাহত ছিল। আঞ্চলিকতার প্রভাবে ক্রমে ক্রমে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লীলা-কীর্তন আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। তবে এর সবচেয়ে চর্চা হয়েছে− উত্তরবঙ্গ, বীরভূম, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা সংলগ্ন বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলসহ মেদিনীপুর, নদীয়া এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে। আঞ্চলিকতার প্রভাবে এবং বিভিন্ন কীর্তনীয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন ধারার সৃষ্টি হয়েছিল। পরে শিষ্য পরম্পরায় এই ধারাগুলো পরিপুষ্ট হয়েছিল।
মঙ্গলকাব্যের কবিরা চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, শীতলামঙ্গলের মাধ্যমে কীর্তনের রস পরিবেশন করতেন বটে, তাতে মূলকীর্তনের ধারা থেকে কিছুটা বিচ্যুত ছিল। মধ্যযুগের শেষে এসে বাংলা গান কীর্তন দ্বারা দুই ভাবে সমৃদ্ধ লাভ করেছে। এর একটি ধারায় মূল কীর্তনীয়ার কীর্তনের আদর্শ ধরে রেখে নতুন নতুন কীর্তন সৃষ্টি করেছেন। অন্য ধারায়, কীর্তনের সুরশৈলী অনুসরণে অন্য ধরনের গান রচনা করেছেন। কীর্তনের আদলে সৃষ্ট গানকে বলা হয় কীর্তনাঙ্গের গান।